মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ! প্রকল্পটির উদ্বোধন উপলক্ষে আপনাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।
কক্সবাজারের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি প্রায় ৬০০ পরিবারকে আশ্রয় দিচ্ছে, এটি আমাদের দেশের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য এ ধরনের পুনর্বাসন প্রকল্প বিশ্বে এই প্রথম, এটি আমাদের জন্য গর্বের উপলক্ষ্য। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, জলবায়ুর প্রধান দুষণকারী উন্নত দেশগুলো জলবায়ু শরণার্থীদের কোনও দায়িত্বই নেয়নি। আমরা আর্মি ইঞ্জিনিয়ার কোরকে ধন্যবাদ জানাই, যারা সেরা দক্ষতার সাথে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।
এই প্রকল্পটিকে ২০১১-১২ সালের দিকে কোস্ট এবং কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দাদের যৌথ আন্দোলনের একটি সাফল্য হিসেবে অভিহিত করা যায়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ঘরবাড়ি হারা হয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপ থেকে বেশ কিছু পরিবার তৎকালীন ধু ধু বালুচর এবং বর্তমান কুতুবদিয়া পাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিল। বেশিরভাগ পরিবারই এসেছিলো কুতুবদিয়া উপজেলার খুদিয়ারটেক এবং উত্তর ধুরং থেকে, এই গ্রামগুলোর বেশির ভাগই ধীরে ধীরে সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে।
নতুন বিমানবন্দর ও বিমান বাহিনীর জন্য স্থাপনা নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করায় উচ্ছেদের মুখে পড়েছিলো কুতুবদিয়া পাড়ার অধিবাসীরা। যথাযথ পুনর্বাসনের দাবিতে বাসিন্দারা একটি আন্দোলন শুরু করেন, তৎকালীন জেলা প্রশাসককে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়, কোস্ট তখন তাদের সহায়তা করেছিলো। ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক সে-সময় কক্সবাজার এবং কুতুবদিয়া পাড়া পরিদর্শন করেন, তাঁদের প্রতিবেদন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে সরকারি কিছু কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোস্ট ট্রাস্টের ভুল বুঝাবুঝি হয়, কোস্ট ট্রাস্টকে কক্সবাজারে নিষিদ্ধ করা হয়। আমরা তখন দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনের মূল বিষয়টি সম্বন্ধে বুঝাতে সক্ষম হই। সবাই একমত হয়েছিলেন যে, কৌশলগত কারণে কক্সবাজারে একটি বিমান বন্দর প্রয়োজন আছে, কিন্তু কুতুবদিয়া পাড়ায় আশ্রয় নেওয়া জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করাটাও জরুরি, আর পর্যটন খাতের বিকাশে, বিশেষ করে দেশের মধ্যবিত্তকে কক্সবাজারের প্রতি আকর্ষণের জন্য কক্সবাজারের সঙ্গে রেল যোগাযোগটি বিমান যোগাযোগের চেয়েও অনেক বেশি প্রয়োজন এবং কার্যকর উপায়। সম্ভবত ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে গিয়ে বিমানবন্দর এবং রেলপথ দুটো নির্মাণের ব্যাপারেই ঘোষণা করেছিলেন।
দু’জন ব্যক্তি এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পারণ করেছিলেন। সেই সময়কার কোস্ট কর্মী নুরুল আলম, তিনি ছিলেন কুতুবদিয়া পাড়ার জনগণের কাছে বেশ প্রিয় ব্যক্তিত্ব, অন্য প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন কুতুবদিয়া পাড়ার নেতা আক্তার কামাল। তারা সবাইকে একত্রিত করেছিলেন এবং এটা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তাদের অনেক ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছিলো। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব নজরুল ইসলাম চৌধুরী এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসক এই আন্দোলনের প্রতি অসাধারণ সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন, তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অঅন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।
বেশ কয়েকবার আমরা তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ডঃ হাছান মাহমুদ (বর্তমান তথ্যমন্ত্রী) এবং বাংলাদেশের জলবায়ু আলোচক দলের প্রধান ড: কাজী খলিকুজ্জামানের সাথে দেখা করেছি। তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়েই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিষয়টি তুলে ধরনে। বিশেষত বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সম্মেলনে তাদের প্রচেষ্টা করার কারণে, ২০১৪ সালের কানকুন চুক্তিতে জলবায়ু উদ্বাস্তু বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেখানেই জলবায়ু পরিবর্তনের উপর ভাষণ দিয়েছেন, তিনি জলবায়ু শরণার্থী এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মারাত্মক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ এই বিষয়টি সর্বন্তরে তুলে ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং প্রখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী দ্বীন মোহাম্মদের তোলা ছবি দিয়ে কোস্ট প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বিশেষ বই প্রকাশ করে, যাতে বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থী বা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১৯, কোপেনহেগেন থেকে মাদ্রিদ পর্যন্ত, প্রতিটি জলবায়ু সম্মেলনে কোস্ট অংশ নিয়েছে, সম্মেলনস্থলে সেমিনার-সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের কথা বলেছে। কোস্ট এখনও Platform on Disaster Displacement এর উপদেষ্টা পরিষদের আছে, ৩২টি দেশ এই প্লাটফরমের সদস। Climate Adaptation Board এর সর্বশেষ সম্মেলনে, কুতুবদিয়া পাড়ার আন্দোলনের গল্পটি অংশগ্রহণকারীদের কাছে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছিলাম । সেটি ছিলো আমার জন্য আবেগ আর সম্মানের একটি বিষয়। আমার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন সদস্য কক্সবাজারে গিয়েছিলেন।
কিন্তু জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংগ্রাম আর গল্পের এখানেই শেষ নয়। অনুমান করা হয় যে, আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রতি ৩ জনের ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। পুরো বিশ্বে প্রতি ১৫ জনের মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তু হবে ১ জন। কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষ সবসময়ই নানা সংকটে ভুগছেন। বর্ষার ছয় মাস তাঁরা জলোচ্ছ¡াস মোকাবেলা করেন। বেড়িবাধের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ আছে, কিন্তু সে বরাদ্দ ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুব কমই কোনও জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের সমীক্ষায় দেখা যায় যে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার লোক কুতুবদিয়া ত্যাগ করেন। তবুও কুতুবদিয়ার মানুষ শক্তিশালী স্থায়ী বাধের আশায় দিন গুণছেন। দেশের বদ্বীপ পরিকল্পনায় স্থায়ী বাধের কথা আছে। দ্বীপটির মানুষজনকে কিভাবে যথার্থ পুনর্বাসন করা যায়, কিভাবে নতুন দক্ষতা দিয়ে তাঁদের জন্য বিকল্প আয়ের পথ নিশ্চিত করা যায়- সেটা ভাবতে হবে। কুতুবদিয়া দ্বীপবাসীর পাশে কোস্ট ছিলো, সবসময় পাশে থাকবে, কারণ কোস্ট শুধু অর্থ সংগ্রহ আর তার বিনিময়ে নামমাত্র কিছু সেবা দেওয়ার মতো একটি এনজিও নয়, এটি বরং গণকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজ সংগঠন, যা এটি নাগরিক অধিকারের পক্ষে কাজ করে এবং প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের দুর্দশার প্রতি আপনার অব্যাহত মনোযোগ প্রার্থনা করছি।
রেজাউল করিম চৌধুরী,
২৩ জুলাই ২০২০
পাঠকের মতামত